ডেইলি ক্রাইম বার্তা ডেস্ক : দিন দিন বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠছে পুরো ঢাকা মহানগর। চর্ম ও ফুসফুসসহ নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন নগরবাসী। ওয়াসার সংশ্লিষ্টদের চরম গাফিলতিতে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, পয়ঃবর্জ্য নিয়ে বিদ্যমান সমস্যা চলছে কয়েক যুগ ধরে। ঢাকায় প্রতিদিন ১৭৫ কোটি লিটার পয়ঃবর্জ্য তৈরি হয়। এর মধ্যে মাত্র ৩৫ কোটি লিটার শোধন করতে পারে সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা ঢাকা ওয়াসা। বাকি ১২০ কোটি লিটার ঢাকা ও চার পাশের নদী, খাল এবং জলাশয়ে মিশে পরিবেশ ও প্রতিবেশ মারাত্মকভাবে দূষণ করছে।
কিন্তু অদ্যাবধি নেয়া হয়নি তেমন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ। অথচ পানির বিলের সঙ্গে পয়ঃবর্জ্য নামে আরেকটি বিল আছে অনেক এলাকায়। সেখানকার গ্রাহকদের কাছ থেকে বিগত বছরগুলোতে গড়ে ২০০ কোটি টাকা আদায় করেছে সংস্থাটি।
এর মধ্যে চলতি অর্থবছরে পানি ও পয়ঃবর্জ্য বিল একত্রে বাড়িয়েছে ২৫ শতাংশ। সেই হিসাবে চলতি অর্থবছরে ৩২৮ কোটি টাকা পয়ঃবর্জ্য বাবদ গ্রাহকদের কাছ থেকে আদায় করা হবে। এত টাকা যায় কোথায়- এমন প্রশ্ন করে সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার পরামর্শ দেন বিশেষজ্ঞরা।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন ঢাকা ওয়াসার প্রধান কাজ হলেও বরাবরই প্রতিষ্ঠানটির পয়ঃনিষ্কাশন কাজে আগ্রহ কম। ফলে ষাটের দশকে প্রতিষ্ঠিত ঢাকা ওয়াসা নগরবাসীকে চাহিদার আলোকে পানি সরবরাহ করতে সক্ষম হলেও পয়ঃনিষ্কাশন সেবা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। কবে নাগাদ ঢাকাবাসীর পয়ঃনিষ্কাশন সেবা নিশ্চিত হবে- সে ব্যাপারে সুস্পষ্ট ধারণা দিতে পারেননি ঢাকা ওয়াসার দায়িত্বপ্রাপ্তরা। আরও জানা গেছে, ঢাকা ওয়াসা নগরবাসীকে দৈনিক ২৫০ কোটি লিটার পানি সরবরাহ করে। আন্তর্জাতিক হিসাব অনুযায়ী সরবরাহকৃত পানির ৭০ ভাগ পয়ঃবর্জ্য তৈরি হয়। সেই হিসেবে ঢাকায় দৈনিক ১৭৫ কোটি লিটার পয়ঃবর্জ্য তৈরি হচ্ছে। এর মধ্যে ঢাকা ওয়াসার দাবি অনুযায়ী ২০ ভাগ অর্থাৎ ৩৫ কোটি লিটার পয়ঃবর্জ্য শোধন করছে। আর ওয়াসার হাতে থাকা একমাত্র শোধনাগারের (পাগলা পয়ঃশোধনাগার) মাধ্যমে এসব বর্জ্য শোধন করা হচ্ছে।
সূত্র জানায়, ঢাকা ওয়াসার মডস জোন-১, ২, ৩, ৫, ৬ ও ৭ এর আওতায় পুরান ঢাকা, ধানমণ্ডি, মোহাম্মদপুরসহ আশপাশের এলাকা, বাসাবো, গেন্ডারিয়া, গুলশান, বনানী, বারিধারা, মতিঝিল, মালিবাগ, সেগুনবাগিচা, মগবাজার, দনিয়া এবং শ্যামপুর এলাকাজুড়ে ৯৬১ কিলোমিটার পয়ঃবর্জ্য সরবরাহ লাইন রয়েছে। এসব এলাকার পাইপলাইনের মাধ্যমে পয়ঃবর্জ্য পাগলা পয়ঃশোধনাগারে যাওয়ার কথা। কিন্তু, রক্ষণা-বেক্ষণের অভাবে এসব লাইনের বেশির ভাগ অকেজো হয়ে রয়েছে। ধানমণ্ডি, মোহাম্মদপুর, গুলশান, বনানী, তেজগাঁও এলাকার পয়ঃবর্জ্য সংযোগ হাতিরঝিল এসে বিচ্ছিন্ন হয়েছে। আর ধোলাইখালে পুরান ঢাকাসহ আশপাশের এলাকার পয়ঃবর্জ্য সংযোগ লাইন বিচ্ছিন্ন হয়েছে ধোলাইখালে। এখানে বিকল্প পাইপলাইন করে সামান্য পরিমাণ পয়ঃবর্জ্য পাগলা পয়ঃশোধনাগারে যাচ্ছে। বাকি পয়ঃবর্জ্য যত্রতত্র খাল, ডোবা, নালা এবং জলাশয়ে মিশে যাচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে নগর বিশেষজ্ঞ ও স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, ‘ঢাকা ওয়াসা ২০ শতাংশ পয়ঃবর্জ্য শোধন করার যে সক্ষমতার কথা বলছে, সেটাও আট বছর আগের। সে সময় প্রচুর অর্থ খরচ করে পানি ও পয়ঃবর্জ্য সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল ওয়াসা। এখন চিত্র তার চেয়েও খারাপ।
তিনি বলেন, ‘ঢাকা ওয়াসার পয়ঃবর্জ্য ব্যবস্থাপনার ব্যর্থতার কারণে ঢাকার ডোবা, নালা, খাল, জলাধার এবং চার পাশের নদীগুলো দূষণ করছে। এমন দূষিত পরিবেশের মধ্যে বসবাস করা আর স্বচ্ছ পানির ডোবা, নালা, খাল বা নদীর পাশে বসবাস করার মধ্যে পার্থক্য তো সবাই বুঝতে পারে। পানির বিলের সঙ্গে পয়ঃবর্জ্য বিল আদায় করে ঢাকা ওয়াসা মূলত গ্রাহকদের সঙ্গে প্রতারণা করছে। একই সঙ্গে রাষ্ট্রের অর্থের অপচয় করছে। বাংলাদেশ পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) চেয়ারম্যান আবু নাছের খান বলেন, ‘ঢাকার পয়ঃবর্জ্যরে ২০ শতাংশ শোধনের যে দাবি করছে, এটা সঠিক নয়। বর্তমানে ঢাকা ওয়াসা সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ পয়ঃবর্জ্য শোধন করতে পারছে। বাকি পয়ঃবর্জ্য নদী, খাল, বিল, ডোবা, নালায় গিয়ে মিশছে।’ তিনি বলেন, ‘ঢাকা ওয়াসাকে এখান থেকে বের হয়ে আসতে হলে পর্যাপ্ত সংখ্যক পয়ঃবর্জ্য শোধনাগার নির্মাণ করতে হবে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সভাপতি ডা. মো. আবদুল মতিন বলেন, ‘পয়ঃবর্জ্য দূষণের কারণে খাদ্যনালী এবং চর্মজাতীয় সব ধরনের রোগ হয়ে থাকে। আর এসব রোগ দীর্ঘস্থায়ী হলে ক্যান্সারে রূপ নেয়।